গল্প-সিনেমা এবং বাস্তবতা - সময় সংবাদ | Popular Bangla News Portal

Breaking

Post Top Ad

Responsive Ads Here

শনিবার, মে ১৫, ২০২১

গল্প-সিনেমা এবং বাস্তবতা

 





মতামত//সময় সংবাদ ডটকমঃ
'দ্যা লোরাক্স' মূলত শিশুদের জন্য Dr. Seuss এর লেখা একটি বই যেটি আজ থেকে ৫০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিলো।পরবর্তীতে ২০১২ সালে সেটিকে সিনেমার রূপ দেয়া হয়।
সিনেমাটি আমি যখন ২০১৪ সালের দিকে প্রথম দেখি তখন সেটি দেখে মনে মনে খুব হেসেছিলাম।ভেবেছিলাম ধুর! এমন আবার হয় নাকি!
বইটি প্রকাশের ৫০ বছর পর আজ আর সেই কাহিনী পড়ে, অথবা ২০১২ তে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি দেখে হাসার উপায় নেই।বাস্তবতার সাথে চরম মিল খুঁজে পাওয়া যায় আজ।


কাহিনীটা ছোট্ট করে আপনাদের সাথে শেয়ার করি-
Thneed-ville নামের একটি শহর আছে।শহরটা খুবই সুন্দর আর পরিপাটি।সিনেমার শুরুতেই শহরটি দেখে আপনি মনে মনে হয়তো আফসোসই করবেন যে এমন একটি শহর আমার হলে কতই না ভাল হতো!কিন্তু যতই সিনেমার গভীরে যাবেন ততই সেই শহরের প্রতি আবার উদ্বেগ বাড়তে থাকবে।শহরটি যথেষ্ট সুন্দর করে গোছানো হলেও সেটি আসলে একটি আর্টিফিশিয়াল শহর।এখানে প্রকৃতি বলতে কিছু নেই।গাছপালা,পশুপাখি সবই এখানে আর্টিফিশিয়াল।এমনকি চাইলেই রিমোট কন্ট্রোলিং করে ইচ্ছা মত মৌসুম পরিবর্তন করা যায়।


এই শহরেরই এক বাসিন্দা ১২ বছর বয়সী টেড,যে কিনা শহরের আরেক বাসিন্দা অড্রি নামের একটি সুন্দরী মেয়ের মন জয় করার অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছে।একদিন টেড জানতে পারলো অড্রির স্বপ্ন হলো বাস্তব গাছ দেখা।টেড ভাবলো বাস্তব গাছ এনে দিতে পারলেই অড্রির হৃদয়ে জায়গা করে নেয়া যাবে।


কিন্তু এটি তো সহজ কাজ নয়।বাস্তব গাছ সে কোথায় পাবে!জন্মগ্রহণ করার পর থেকে সে কোনদিন বাস্তব কোন গাছ দেখেনি।শহরের সবাই এই আর্টিফিশিয়াল জগতেই অভ্যস্ত।
ওহ,এখানে আরেকটি কথা বলে নেয়া দরকার,সেটি হলো- শহরের সবাই অক্সিজেন ক্রয় করে ব্যবহার করে।টেড বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করে যখন কোন বাস্তব গাছের হদিস পেলো না,তখন সে তার নানীর থেকে জানতে পারলো শহরের বাইরে এমন এক জায়গা আছে যেখানে আসল গাছ রয়েছে।


অদম্য মনোবলের অধিকারী টেড ছুটে গেল সেদিকে।শহরের বলয়ের বাইরে গিয়ে দেখলো হাজার হাজার বাস্তব গাছ,আসল প্রকৃতি।সেখান থেকে গাছ কেটে আনতে গিয়ে সে মহাবিপদে পতিত হয়।
শহরের মেয়র ছিলেন একজন লোভী মানুষ।শহরটাকে প্রকৃতির বাইরে রেখে সে অক্সিজেন ব্যবসা করে আসছিলো দিনের পর দিন।
অনেক বাধাবিপত্তির পরে টেড একটি বীজ আনতে সক্ষম হয় এবং শেষ পর্যন্ত শহরটি আসল প্রকৃতির ছোয়া পায়।মানুষ আর্টিফিশিয়াল শহরের বদলে দেখতে পায় একটি আসল প্রকৃতির শহর।

এটি গেলো সিনেমার মূল গল্প।একবার ভাবুন তো,আপনি-আমি এখন যে শহরে বাস করি সেই শহরের সাথে কিছুটা হলেও সাদৃশ্য খুঁজে পান কিনা।অথবা ৫০ বছর পরে এই শহরের চিত্রটা কেমন হবে একবার ভেবে দেখুন তো।

একদম ছোট সময় থেকে বইপুস্তকে এই একটি কথা বিভিন্ন জায়গায় পড়েছি, "একটি দেশে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন"।

আমাদের দেশে কি অবস্থা জানেন?
রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে প্রবেশের পর তাদের থাকার জায়গা করে দেয়ার জন্য উখিয়া ও টেকনাফে উজাড় করা হয়েছে পাঁচ হাজার একর বনভূমি।মহেশখালীতে সংরক্ষিত বনের ২০০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছিলো অপরিশোধিত তেলের ডিপো এবং পাইপলাইন স্থাপনের জন্য।এই জায়গাতেও অনেক গাছপালা ছিল।

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প


বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ(জিএফও) এবং ওয়ার্ল্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট ২০১৮ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়েছিলো ২০১১-২০১৮ অর্থাৎ এই সাত বছরে ৩ লাখ ৩২ হাজার একর বন উজাড় করা হয়েছে।

তারও পূর্বে সিডর আমাদের কত বড় ক্ষতিসাধন করে দিয়ে গিয়েছে তাও আমাদের সবার জানা।কিন্তু সিডরের আঘাত সুন্দরবন কিভাবে প্রতিহত করেছিলো সেটিও সবার জানা উচিত বলে আমি মনে করি।সেদিন সুন্দরবনের জন্যই উপকূলবর্তী এলাকার লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফেরত এসেছিলো।আর আমরা প্রায়ই সেই গাছের গুরুত্ব ভুলে যাই।অবকাঠামোগত  উন্নয়নের সাথে বনভূমি উজাড়ের কোন আবশ্যিক সম্পর্ক নেই।কিন্তু কেন যেন আমরা এই দুটো জিনিসকে এখন আর আলাদা ভাবতে পারি না।খুঁজে খুঁজে এমন সব জায়গাই বেছে নেই যেখানে গাছ কাটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়।


পুড়ে যাচ্ছে সুন্দরবন 


গত দুই দশকে সুন্দরবনে আগুন লেগছে প্রায় ২৪ বার।পুড়েছে ৮২ একর বনভূমি।তবু আমাদের মাথাব্যথা নেই।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটার হিসাব রাখেনি কর্তৃপক্ষ।তবু আমাদের মাথাব্যথা নেই।সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মানুষ খাবার কিনে খাবে,পানি কিনে খাবে,সেজন্য স্থাপিত হচ্ছে দোকান।আমার মনে হয় সেখানে অক্সিজেন বিক্রির কিছু আগাম দোকান ভাড়া দিয়ে রাখলে বিষয়টি দুই দিক দিয়েই সুবিধাজনক হবে।একদিকে যেমন দোকান ভাড়ার থেকে আয় হবে, অন্যদিকে দেশের ক্রান্তিলগ্নে অক্সিজেনের অভাবের সময় মানুষ এখান থেকে খাবারের পাশাপাশি অক্সিজেনও কিনতে পারবে।Thneed-ville শহরটির সাথে মিল রেখে এরকম সুদুরপ্রসারি চিন্তা করে রাখাই ভাল।

গাছকে কম গুরুত্ব দেয়ায় শুধু বাংলাদেশকে ঢালাওভাবে দোষ দেয়াও বোকামির শামিল।আমাদের কাছাকাছি রাষ্ট্র চীন এদিক দিয়ে অনেক এগিয়ে।উন্নত দেশগুলো একসঙ্গে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ঘটায়,চীন একাই তার চেয়ে বেশি গ্যাস নিঃসরণ করে।তাদের পরেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।অথচ এই উন্নত রাষ্ট্রগুলো চাইলেই বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষার বিরাট পরিকল্পনা গ্রহণ করে কাজ করতে পারে।
ইদানীং অবশ্য জলবায়ু নিয়ে বেশ দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন জন কেরি সাহেব।বিভিন্ন দেশে দেশে যাচ্ছেন জলবায়ু সম্মেলনের দাওয়াত নিয়ে।
সাম্প্রতিক সৌদি আরবের নেয়া সিদ্ধান্তের প্রশংসা না করে পারা যায় না।নিজের দেশে আগামী দশ বছরে কোটি কোটি গাছ রোপন করবে দেশটি।এমনকি তারা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রেও শত কোটি গাছ রোপন করবে।


এইযে এখন একটি কঠিন সময় যাচ্ছে।উন্নত প্রত্যেকটি রাষ্ট্র যেখানে পরিবেশ রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বৃহৎ পরিসরে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে,ঠিক এই সময়ে আমরা কি করছি?
মুজিব শতবর্ষ হিসেবে আমরা প্রায় কোটি বৃক্ষ হয়তো রোপন করেছি,সেটি কি আমাদের দেশের জন্য পর্যাপ্ত?২৫ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা আমরা অর্জন করতে পেরেছি?যদি না পেরে থাকি তাহলে কেন উন্নয়নের জন্য আমার গাছ কাটা প্রয়োজন?জানি না এর উত্তর কোথায় পাবো।
যেখানে মাত্র কয়েকদিন আগেই ১০ জন নোবেলজয়ী ব্যক্তি সম্মিলিতভাবে বলেছেন বড় হুমকির মুখে পড়বে মানবজাতি,সেখানে আমাদের মাথাব্যথা নেই।
আমরা বন উজাড় করি একদিক দিয়ে,বৃক্ষরোপন করি অন্যদিক দিয়ে।কিন্তু পরিমাণে বেশ তারতম্য।সমস্যাটা এখানেই বেশি মনে হয়।

FAO এর মতে আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৩ শতাংশ। যদিও আমাদের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মতে সেটি ১৭ শতাংশ। অথচ আমাদের দরকার ছিলো ২৫ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে অতিরিক্ত আরো বনভূমির সৃষ্টি করা।

আশা করব যেন ভবিষ্যতে কোন আর্টিফিশিয়াল শহরে বসবাস করে রিমোট চেপে পাখির কলতান শুনতে না হয়।যেন কোন কোম্পানির নিকট থেকে অক্সিজেন ক্রয় করে নিঃশ্বাস নিতে না হয়।লোরাক্স যেন গল্পের বইতেই রূপকথা হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকে।আমরা সত্যিকারের লোরাক্সের মুখোমুখি হতে চাই না।

লেখকঃ
মোঃ রিয়াজুল ইসলাম রিয়াদ
শিক্ষার্থী,দর্শন বিভাগ,জাহাঙ্গীরনগর  বিশ্ববিদ্যালয়।

Post Top Ad

Responsive Ads Here