প্রতিবাদের আগুনে আবরারকে স্মরণ করলো গাল্লি বয় - সময় সংবাদ | Popular Bangla News Portal

শিরোনাম

Monday, October 14, 2019

প্রতিবাদের আগুনে আবরারকে স্মরণ করলো গাল্লি বয়


সময় সংবাদ ডেস্ক//
মাসকয়েক আগে ‘গাল্লি বয়’ নামের একটা সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল বলিউডে, নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রনবীর সিং। মুম্বাইয়ের ধারাবি বস্তি থেকে উঠে আসা এক ছেলে জীবনের বঞ্চনা আর কষ্টগুলোকে লাইন বানিয়ে র‍্যাপ গানের মাধ্যমে শোনাচ্ছে পুরো দুনিয়াকে- এমনই একটা গল্প দেখা গিয়েছিল সেই সিনেমায়। গত মে মাস থেকে বাংলাদেশেও এমন একজন গাল্লি বয়ের আবির্ভাব ঘটেছে, রানা নামের এক পথশিশুর গলায় উঠে এসেছে জীবনের বাস্তবতার গল্প, সেই গল্পে মিশে আছে অপ্রাপ্তির দুঃখগাঁথা আর শ্রেণীবৈষম্যের যাতনা।

পথশিশু রানাকে গাল্লি বয় বানানোর রূপকার মাহমুদ হাসান তবীব নামের এক তরুণ। তিনি পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী সাহিত্য বিভাগে। রানার সুপ্ত প্রতিভা তার চোখেই ধরা পড়েছিল সর্বপ্রথম, রানার কণ্ঠে যে গানগুলো ভাইরাল হয়েছে গত কয়েক মাসে, সেগুলো তবীবেরই লেখা। বুয়েটে সম্প্রতি নিহত হওয়া আবরার ফাহিমকে নিয়ে সবশেষ গানটি এসেছে এই জুটির কাছ থেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরে বেড়ানো পথশিশু রানার জন্ম রাজধানীর অদূরে কামরাঙ্গীরচরের পূর্ব রসূলপুর এলাকায়। তার মা লোকের বাড়িতে কাজ করেন, বাবা মাছ ধরার ছিপ, পলো ইত্যাদি বানায়। রানারা দু’ ভাই। অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা করা হয়নি কারোরই। সারাদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশেষ করে টিএসসিতে ফুল বিক্রি করে দিন পার করে সে।



জীবনটা হয়তো কাগজ কুড়িয়ে আর ফুল বিক্রি করে কেটে যেতো রানার, যদি তবীবের সঙ্গে তার পরিচয় না হতো। তবীব মোটরসাইকেল নিয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন রানা তার বাইকে চড়ার আবদার করে। রানাকে বাইকে তুলে নিলেন তবীব, ঘুরতে ঘুরতে গান গাইতে পারে কি না জানতে চাইলে রানা তবীবকে একটা র‍্যাপ গান শোনালো।

তবীব বেশ আগে থেকেই র‍্যাপ গানের প্রতি আগ্রহী ছিলেন, এমিনেম তার প্রিয় শিল্পী। এলাকার বড় ভাইদের কাছে শুনেই র‍্যাপ সঙ্গীতের প্রতি তার ভালুক বাসা জন্মেছিল। রানার গান শুনে তবীবের মনে হলো, ছোট মানুষ হলেও র‍্যাপ গাওয়ার জন্য যথেষ্ট এনার্জি আছে রানার গলায়। তবীব রানাকে নিয়ে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই তার এক বন্ধুর বাসায়। গান লেখা হলো, সুর দেয়া হলো, কয়েকদিনের চেষ্টায় সেটা গলায় তুলেও ফেললো রানা। এরপর রেকর্ডিং করা হলো পুরো গানটা, ভিডিও নিয়ে কাজ শুরু করলেন তবীব।



এরইমধ্যে ঘটলো আরেক ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়েরই কয়েকজন শিক্ষার্থী রানাকে ঈদের জামা দেওয়ার কথা বলে টিএসসিতে বসে ‘ঢাকাইয়া গাল্লি বয়’ গানটি গাইতে বলে ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে। তবীব এসবের কিছুই জানতেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া গানটা চোখে পড়ার পরেই ঘটনা জানতে পারেন তিনি। রানা ততদিনে অনেকের কাছেই পরিচিত হয়ে গেছে।



গাল্লি বয় নামকরণটা তবীব করেছেন বলিউডি সেই সিনেমা থেকেই। তবীব নিজেও মনে করেন, গানের সামর্থ্য আছে সমাজের অনাচার, অবিচার আর শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলার, অত্যাচারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হয়ে রুখে দাঁড়ানোর। আর হিপহপ গানের কালচারটা জনপ্রিয় হওয়ায় তরুণদের কাছে খুব দ্রুত এটা পৌঁছে যেতে পারে, রানাকে সঙ্গে নিয়ে সেই কাজটাই তবীব করে চলেছেন, তার গানে তুলে আনছেন বৈষম্যের কথা, নিপীড়নের কথা।

তবীবের লেখা আর রানার কণ্ঠে বরাবরই ফুটে উঠেছে প্রতিবাদী সুর, অনিয়ম আর অসঙ্গতির দিকে বারবার আঙুল তুলেছেন দুজনে। শেয়ার বাজার, ক্যাসিনো চক্র কিংবা পর্দা-বালিশ দুর্নীতি, কোনকিছু বাদ পড়েনি তাদের রাডার থেকে। এখানেই গাল্লি বয় ব্যতিক্রম, অনন্য। এই তালিকার সবশেষ সংযোজন আবরার ফাহাদ, বুয়েটে ছাত্রলীগের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়া এই ছাত্রকে দুজনে স্মরণ করেছেন গানের মাধ্যমে। ‘হিপহপ পুলিশ’ শিরোনামের এই গানে তবীব লিখেছেন- ‘ঘুষ অনিয়মিত লিখছে কলম/ তোমাদের যত কুকীর্তি/ আমি রানা আমার সবটা জানা, বলে দেবো করে আবৃত্তি/ এই শহরের কপাল থেকে পড়েছে ঘুষের রাজটিকা/ নায়িকার ঘড়ি কত দামে কেনা, খবর ছাপছে পত্রিকা’ৃ এই গানটাও যেন হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের এক ভাষা।



গাল্লি বয়ের ভক্ত এখন হাজার হাজার। একেকটা ভিডিও বের হলেই সেটা লাখো দর্শকের কাছে পৌঁছে যায় মূহুর্তের মধ্যে, লাইকের বন্যায় ভাসতে থাকে গানগুলো। আপাতত পুরো প্রোজেক্টটার খরচ বহন করছেন তবীব নিজেই, তার ইচ্ছে আছে গাল্লি বয়কে নিয়ে সামনে আরও বড় পরিসরে কাজ করার। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির লোকজন তাদের পাশে দাঁড়াবেন বলেই তার আশা। আপাতত তিনি নিজের গ্র‍্যাজুয়েশনটা শেষ করতে চান, তারপর মাস্টার্স এবং পিএইচডিটাও সেরে ফেলবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে- এমনই তার পরিকল্পনা।

আর আমাদের ছোট্ট রানা, গাল্লি বয় হয়ে যার জীবনটাই বদলে গেছে, তার পরিকল্পনা কি? রানা পড়াশোনা করতে চায়, আর্মিতে যোগ দিতে চায়। সে এখন আর কাগজ কুড়োয় না, ফিটফাট জামাকাপড় পড়ে ঘুরে বেড়ায়, স্কুলে যায় নিয়মিত। স্কুলের সহপাঠীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতেও থাকে সে। পথেঘাটে তাকে দেখলে অনেকেই পরিচয় জানতে চায়, পরিচয় পেলে সেলফি তোলে তার সঙ্গে। যার গানের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে গেছে, তাকে তো এইটুকু খ্যাতির বিড়ম্বনা পোহাতে হবেই!

No comments: