জাহাঙ্গীর আলম, টাঙ্গাইল
নৌকা
কালের বির্বতনে এবার হারিয়ে যেতে বসেছে এ শিল্পটি। নৌকা তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি ও আর্থিক অনটনের ফলে এ শিল্পের কারিগররা এখন পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে নৌকা শিল্প। তাছাড়া আর্থিক দুরাবস্থা এবং নৌকা তৈরির উপকরণের মূল্য দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় কারিগররা তাদের প্রাচীন এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে।
এক সময় নদী তীরের গ্রামগুলোতে প্রবেশ করলেই প্রত্যেক বাড়ি থেকে ঠকঠক শব্দ ভেসে আসতো। কাঠে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক মেরে নৌকা তৈরির শব্দ শোনা যেত পুরো গ্রামজুড়ে। আজকাল সেই শব্দ আর কানে আসেনা। শত অভাব-অনটনের মধ্যেও টাঙ্গাইলের কিছু কারিগর এ ঐতিহ্যবাহী পেশাটি এখনও আকঁড়ে ধরে আছে। বাকী কারিগররা এখন পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করেছে। একসময় কালিহাতী উপজেলার আউলিয়াবাদ বাজার, রৌহা বাজার ও ঘাটাইল দেওপাড়া বাজারে বর্ষা মৌসুমের সময় বাজারের কাছে নৌকাগুলো সারি হয়ে থাকতে দেখা যেত। তখন নদী তীরের মানুষেরা নৌকা করে বাজার গিয়ে তাদের প্রয়োজনী দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় করতো।
নৌকা কারিগররা জানান, কারিগররা নৌকা তৈরিতে কড়ই কাঠ ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও রেইন্ট্রি, আম, তুলা কাঠ, গজারি কাঠ দিয়ে এসব নৌকা তৈরি করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে গজারি কাঠ দিয়েই বেশির ভাগ নৌকা তৈরি করে। এসব নৌকা কালিহাতী উপজেলার আওলিয়াবাদ, টাঙ্গাইল সদরের কাতুলি, নাগরপুরসহ বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করা হয়।
রৌহা গ্রামের মোস্তফা জানান, এক সময় বিয়ে-শাদিতে এক গ্রামের বরযাত্রী অন্য গ্রামে নৌকা সাজিয়ে নিয়ে যেত বিয়ের জন্য। গ্রামগুলোর প্রত্যেক ঘরেই ২/৩টি করে নৌকা ছিল। স্কুল-কলেজ, হাটবাজার, মাল আনা-নেওয়ার কাজে এসব নৌকা ব্যবহার করা হত। গত ১৫/১৬ বছর ধরে এ দৃশ্য আর দেখা যায় না। এখন প্রায় প্রতিটি গ্রামেই রাস্তা নির্মাণ হওয়ায় নৌকার ব্যবহার অনেকটা কমে গেছে।
ঘোড়া গাড়ী
প্রাচীনকাল থেকে সড়ক যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত ঘোড়ার গাড়ী আধুনিক যান্ত্রিক যানবাহনের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তি’র পথে! আধুনিক যানবাহনের ইঞ্জিনের স্পর্শে আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী অনেক যানবাহনই কালপরিক্রমায় পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের ধারক-বাহক অনেক বাহনেরই আমূল পরিবর্তন, আধুনিকায়ন সাধিত হয়েছে। আবার ঐতিহ্যবাহী অনেক বাহনই হারিয়ে গেছে দৃশ্যপট থেকে। তেমনি মান্ধাতা আমলে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ঘোড়ার সাহায্যে চলমান ঘোড়ার গাডী বহুবিধ কারণে বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে দৃশপট থেকে। কয়েক বছর আগেও কালে ভদ্রে দু’একটি গোড়ার গাড়ীর দেখা মিললেও বর্তমানে তা ডুমুরের ফুল।
জানা গেছে, প্রাচীনকাল থেকে গাঁও গেরামে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হতো ঘোড়ার গাড়ীর অবকাঠামো। আর কেটে পুরিয়ে গোলাকার করে পেরেক মেরে তৈরি করা হতো চাকা। ওই গাড়ীকে টেনে নেয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো ঘোড়াকে। কালের আবর্তে ঘোড়ার গাড়ীর ব্যবহার কমে যেতে থাকলেও এখনও বিশ্বে আধুনিক সকল যানবাহনের জন্য তৈরিকৃত সকল ইঞ্জিনের ক্ষমতাকে ঘোড়ার শক্তি (অশ্বশক্তি) হিসাবে পরিমাপ করা হয়েছে থাকে। যে ইঞ্জিনের অশ্বশক্তি (হর্স পাওয়ার) যত বেশী তার পরিবহন ক্ষমতা ও মূল্যও তত বেশী হয়ে থাকে।
সুপ্রাচীনকাল থেকে দেশের গ্রামীণ জনপদের কাঁচা মেঠো পথে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে গরুর গাড়ী, মহিষের গাড়ী ও ঘোড়ার গাড়ীর বহুল প্রচলণ পরিলক্ষিত হতো। কিন্তু যখন থেকে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানী দ্বারা চালিত ইঞ্জিন দিয়েছে তৈরি যানবাহনের প্রচলণ ঘটতে থাকে তখন থেকেই মান্ধাতা আমলের দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরিকৃত ‘ঘোড়ার গাড়ী’র কদর ও ব্যবহার হ্রাস পেতে থাকে। বর্তমানে দেশের গ্রামীণ জনপদের বেশীরভাগ কাঁচা ও মেঠোপথ/সড়ককে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ওইসব সড়ককে পিচপাথর দিয়ে পাকা সড়কে রূপদান করা হয়েছে। সড়কে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে জায়গা করে নিয়েছে যান্ত্রিক ইঞ্জিন দ্বারা চালিত বাস, মিনিবাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, সিএনজি অটোরিক্সা, নছিমন, করিমনরা।
নদীমাতৃক এ দেশের চরাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহনে দু’একটি ঘোড়ার গাড়ীর দেখা মিললেও ক্রমান্বয়ে তাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে প্রাচীনকাল থেকে সড়ক যোগাযোগে বহুল জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ‘গোড়ার গাড়ী’ বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায় হয়ে পড়েছে।