টাঙ্গাইলে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া এক এএসপি’র গল্প - সময় সংবাদ | Popular Bangla News Portal

Breaking

Post Top Ad

Responsive Ads Here

সোমবার, জানুয়ারী ০৬, ২০২০

টাঙ্গাইলে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া এক এএসপি’র গল্প


হাফিজুর রহমান.টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি//
এ বছর বেগম রোকেয়া দিবসে টাঙ্গাইলে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন মারুফা নাজনীন। জীবনের শুরুতে কঠোর দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে তিনি এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। তার এ সংগ্রামের একমাত্র সহযোগী ছিলেন তার মা ফরিদা ইয়াছমিন। নিঃস্ব ফরিদার আয়ের কোন উৎস না থাকায় বাজারের ব্যাগ সেলাই করে অত্যন্ত স্বল্প আয়ে সংসার খরচ চালিয়েছেন। কখনো অনাহারে, অর্ধাহারে থেকেও মেয়ে মারুফার পড়াশুনার খরচ চালিয়ে গেছেন। মা মেয়ে শেষ পর্যন্ত সমন্ত প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করে জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন।

মারুফা নাজনীন একজন দায়িত্বশীল উর্দ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা। বর্তমানে তিনি ল²ীপুর জেলার রামগাতি সার্কেল এএসপি হিসেবে কর্মরত  আছেন। মারুফা নাজনীন টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল পৌরসভার শহীদ আব্দুস সাত্তার রোডের বাসিন্দা। তার বাবার নাম আখতার হোসেন, মায়ের নাম ফরিদা ইয়াছমিন।
 
এই দম্পত্তির তিন সন্তান জন্মের পর আক্তার হোসেন স্ত্রীকে ছেড়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং তিনি স্ত্রী সন্তানকে পরিত্যাগ ছেড়ে চলে যান। ফলে সন্তানদের নিয়ে ফরিদা ইয়াছমিন অসহায় হয়ে পড়েন। সন্তানদের খাওয়া পড়া এবং লেখা পড়ার খরচ চালানো তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। নিরুপায় হয়ে ফরিদা ইয়াছমিন দিনরাত পরিশ্রম করে বাজারের ব্যাগ সেলাই এবং তা বাজারে বিক্রি করে কোনমতে সংসার চালানোর ব্যবস্থা করেন। কোন কোন দিন আধোপেটা খেয়ে দিন কাটান।

তিন ভাই বোনের সংসারে মারুফা নাজনীন সবার বড়। তার বাবার আরও একটি সংসার ছিল। তাই তাদের ঠিক মতো ভরণপোষণ করতেন না। দুই তিন মাস পর বাবা একবার তাদের সাথে দেখা করতে আসতেন। আবার কোন সময় আসতেন না। বাবা দুই তিন দিন পর পর দুইশত করে টাকা পাঠাতেন। তা দিয়ে ছোট বোনের এক প্যাকেট দুধ আর এক কেজি চিনি কিনলে এক কেজি চাল কেনার মতো টাকা থাকতো না। যেখানে চাল কেনার টাকা নেই সেখানে বাজার কেনার কথাটা থাক।

মারুফা বলেন, মা ভাত রান্না করতো আর মা মেয়ে দু’জনে লবণ পানি দিয়ে খেয়ে দিন পার করতাম। আমার পড়ালেখার জন্য বাবা কখনো ভাবতো না।

মারুফা নাজনীনের মা ফরিদা ইয়াছমিন মারুফা নাজনীন বলেন, নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় পড়াশোনা একেবারে প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। টাকার অভাবে নবম শ্রেণীতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারিনি। এক বছর লেখাপড়া বন্ধ ছিল। পরের বছর মা তার কানের এক জোড়া দুল বিক্রি করে অতি কষ্টে ঘাটাইল এস.ই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগীতায় বোর্ড থেকে রেজিস্ট্রেশন করে আনেন। দশম শ্রেণীতে ক্লাস শুরু করেন। মা ঠিক মতো খাতা কলম কিনে দিতে পারতো না। একটা ছাড়া দুইটা জামা আমার ছিল না।

তিনি আরো বলেন, মা সেলাইয়ের কাজ জানতো। সেসময় একজন লোকের কাছ থেকে ১৫শ’ টাকা ধার করে কিস্তিতে একটা সেলাই মেশিন কিনেন। এরপর রান্নাসহ ছোট দুই ভাই বোনের দেখাশোনার কাজ আমার উপর এসে পড়ে। মা শুরুতে বাজার করার ব্যাগ সেলাই করতেন। প্রতি ব্যাগে পেতেন ২০ পয়সা করে। তারপর এলাকায় পরিচিত হলে কাপড় সেলাই করা শুরু করেন।
 
মারুফা বলেন, এভাবেই চলতে থাকে আমাদের সংসার। পড়ালেখার পাশাপাশি রাত জেগে মায়ের কাজে সাহাস্য করতাম। এরই মধ্যে এসএসসি’র টেস্ট পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করি আমি। পরে স্কুলের ইংরেজি স্যার খাজা ফেরদৌস বাসায় এসে আমাকে এক রীম খাতা এবং দশটা কলম উপহার দেন। সেই সময় স্যার বলেছিলেন, তোর কাছে একটাই চাওয়া, শুধু ভালো একটা রেজাল্ট এনে দিবি। স্যার সবসময় আমার খোঁজ নিতেন। আমি সারা জীবন স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ। এসএসসি পাস করার পর ঘাটাইল জি.বি.জি কলেজে ভর্তি হই। কলেজে বেতন দিতে হতো না। স্যারেরা আমাকে প্রাইভেট পড়াতেন ফ্রিতে। এভাবেই এসএসসি এবং এইচএসসি’র সময়কাল পার করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আমার হবে না, তাই ঘাটাইলেই বিএসসি করবো, এমন সিদ্ধান্ত নিলাম।

হঠাৎ একদিন মা বললেন, তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াবো। আমি বললাম ফরম কিনে দিতে পারবে না কিভাবে পরীক্ষা দেব। যাক মায়ের কথা মতো শুরু হলো ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি। চান্স পেয়ে গেলোম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে। পড়ালেখার পাশাপাশি প্রাইভেট পড়াতাম। এরই মাঝে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে শিক্ষাঋণ নেই। অনার্স শেষ বর্ষে এসে আমার বিয়ে হয়। মাস্টার্স পড়ার খরচ স্বামী চালিয়েছেন। মাস্টার্স শেষ করে ৮ মাস একটি এনজিওতে চাকরি করি। এরই মধ্যে ফার্ম স্ট্রাকচার এর উপর থিসিস শেষ করি। পরে ফেনী সিটি কলেজে কৃষি বিষয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি।

চাকরিরত অবস্থায় ৩৩ তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেই। বিসিএস চূড়ান্ত ফলাফলে পুলিশ প্রশাসন (এ.এস.পি) পদে টিকে যাই। এ খবর শোনার পর সেদিন আনন্দে অনেক কেঁদেছিলাম। আর আমার মা খুশিতে রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে থাকেন। দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তায় যাকে পান তাকেই বলতে থাকেন আমার মেয়ে এ.এস.পি হয়েছে আর কাঁদতে থাকেন।

আমি সর্বশেষে একটি কথাই বলতে চাই আমার মায়ের মতো মা যেন সব ছেলে মেয়েদের হয়। ব্যবসায়ী স্বামী মুজিবুল কাইয়ুম আরমান আর একমাত্র সন্তান শায়ানকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন বলে জানান।

মা ফরিদা ইয়াছমিন বলেন, আল্লাহতালার আমাদের প্রতি দয়া ছিল। আমার পরিশ্রম আজ স্বার্থক। সংগ্রামী এই জননীর আরেক মেয়ে নুসরাত জাহান ইভা পড়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ১ম বর্ষে ও একমাত্র ছেলে ইফতেখাইরুল হাসান পড়ে মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে অনার্স ১ম বর্ষে।

টাঙ্গাইল এ বছর জেলা পর্যায় জয়িতাদের সম্মাননা দেওয়ার অনুষ্ঠানে মারুফা বলেন, আজ আমাকে আপনারা যে সম্মাননা দিচ্ছেন, আসলে এই সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য আমার মা। ওই দিন মঞ্চে জেলা প্রশাসক মা-মেয়ের হাতে জেলার সেরা জয়িতার ক্রেস্ট তুলে দেন।


Post Top Ad

Responsive Ads Here