সড়ক ও জীবন - সময় সংবাদ | Popular Bangla News Portal

শিরোনাম

Monday, June 14, 2021

সড়ক ও জীবন

 




মতামতঃ


সড়ক মহাসড়ক এখন দূর্ঘটনার আকর আর যান্ত্রিক যানগুলো ঘাতক-দৈত্য।আমরা কেউ জানি না জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে যেয়ে সুস্থ দেহে ফিরে আসতে পারব কি-না।কেননা অহরহ দূর্ঘটনার বলি হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। কেউ আহত হচ্ছে, কেউ জীবনের তরে পঙ্গু হচ্ছে, আবার কেউ হারাচ্ছে অকালে তার মূল্যবান জীবন। একটা জীবন হারিয়ে পরিবারের  অনেক মানুষ মারাত্মক দুর্দশার শিকার হচ্ছে, অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পথে বসছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সন্তানদের লেখাপড়া, চিকিৎসা। খাওয়া-পরা জোটাতেই হিমসিম খাচ্ছে এসব পরিবারের সদস্যরা।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর পরসিংখ্যানে বলা হয়েছে যে,বিশ্বে সড়কে প্রতি বছর প্রায় ১.৩ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় এবং ২০ থেকে ৫০ মিলিয়ন এর মধ্যে অ-প্রাণঘাতী জখম থাকে।সড়ক নিরাপত্তা গ্লোবাল স্থিতি প্রতিবেদনে ১৭৮ টি দেশের  সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ফলাফলে দেখা যায় যে সড়কে ট্রাফিক দূর্ঘটনার একটি গুরুত্বর্পূণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা রয়ে গেছে,বিশেষত স্বল্প আয়ের এবং মধ্যম আয়রে দেশগুলোর জন্য।


অন্যদিকে বাংলাদেশে  ২০২০ সালে সড়ক দূর্ঘটনায়  ৪ হাজার ৯৬৯ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮৫ জন। এসময় মোট ৪০৯২ টি সড়ক র্দূঘটনা ঘটে। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে সড়ক র্দূঘটনার এ পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংস্থা ।


সড়ক দূর্ঘটনার একাধিক কারণ রয়েছে,যেগেুলো হল দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা, দৈনিক চুক্তভিত্তিকি গাড়ি চালানো, লাইসন্সে ছাড়া চালক নিয়োগ, পথচারীদরে মধ্যে সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং করা,বিরতি ছাড়াই র্দীঘসময় ধরে গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো , আইনরে প্রয়োগ না থাকা, সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি বৃদ্ধি, মহাসড়ক নির্মাণে ত্রুটি, একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও শ্লথ যানবাহন চলাচল এবং রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাট থাকা, মোটরযানে হেলমেট ব্যবহার না করা, সিটবেল্টের অর্পযাপ্ততা,যানবাহনে শিশুদের জন্য নিরাপদ আসন না থাকা প্রভৃতি।


সড়ক নিরাপত্তা জোরদার করতে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রত্যেক  বছর "UN Global Road Safety Week" পালন করা হয়। "জীবনের জন্য সড়ক (Streets for Life)" এই স্লোগানকে সামনে রেখে এই বছর ১৭ থেকে ২৩ মে  এই সপ্তাহ পালিত হচ্ছে।


এটি সামনে রেখে বড় বড় শহর এবং পথচারী বহুল এলাকাগুলোতে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ । ৮০ টির বেশি বড় বড় শহরে পরিচালিত সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে  জাতিসংঘ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার করা গেলে সড়ক দূর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এতে যানযট ও বায়ুদূষণ কমে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।


বিভিন্ন উচ্চ আয়ের দেশের পাশাপাশি আফ্রিকা ,উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ার তুলনামূলক কম আয়ের অনেক দেশ যানবাহনের গতিসীমা ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার সফলভাবে বাস্তবায়ন  করতে সক্ষম হয়েছে। এই সমীক্ষায় দেখা গেছে,ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার সর্বোচ্চ গতিসীমায় তানজানিয়াতে ২৫ শতাংশ,ইংল্যান্ডে ৪২ শতাংশ এবং ব্রিস্টলে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত সড়ক দূর্ঘটনা কমেছে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে ,যানবাহনের গতিসীমা ১ কিলোমিটার বাড়লে সড়ক দূর্ঘটনার ঝুঁকি ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।


বাংলাদেশে চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠোর বিধান যুক্ত করে কার্যকর করা হয়েছে বহুল আলোচিত “সড়ক পরিবহন আইন ২০২৮”। সড়ক দূর্ঘটনা হ্রাস ও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ অর্জনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার এ আইন প্রণয়ন করে।


এই আইনে শুধু চালক ও পারিবহন মালিক নয়,এবার পথচারীদেরও শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। চালককে সংকেত মানতে হবে। পথচারীকেও সড়ক, মহাসড়কে জেব্রা ক্রসিং, ওভার ব্রীজ, আন্ডারপাস ব্যবহার করতে হবে। যত্রতত্র রাস্তা পার হলে পথচারীকে ১০ হাজার টাকা গুনতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে কোন চালক যদি দূর্ঘটনার মাধ্যমে কোন ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটান তাহলে তার বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০২ ধারায়ই মামলা হবে।এর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড।তবে দূর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর জন্য চালকদের সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর কারাদন্ড। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কেউ যানবাহন চালালে তার শাস্তি ৬ মাসের কারাদন্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং এর জন্য ৫ হাজার টাকা জরিমানা। নিবন্ধনহীন যানবাহনের জন্য শাস্তি ছয় মাসের কারাদন্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইলে ফোনে কথা বললে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে এক মাসের জেল ও ১০ টাকা জরিমানা আদায়ের বিধান রয়েছে।


বাংলদেশের বর্তমান আইনটির এখনও কিছু দূর্বল দিক রয়েছে যার জন্য সড়ক ব্যবহারকারীরা আইন লঙ্ঘন ও দূর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। “সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮” চলতি বছরে সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন সরকার।গাড়ির গতি নিদিষ্ট করে দেওয়া,চালক ও যাত্রীদের জন্য সিটবেল্ট ব্যবহার বাধ্যতামূলক,মানসম্মত হেলমেটের ব্যবহার ,শিশুদের জন্য নিরাপদ আসন নিশ্চিত করা ইত্যাদি সংশোধিত আইনে অন্তর্ভূক্ত করা একান্ত জরুরী।


সড়ক নিরাপত্তা ও সড়কে নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি ঢাকা আহছানিয়া মিশন কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত UN Global road Safety Week-2021 পালনে সপ্তাহব্যাপী (১৭-২৩ মে) ঢাকা আহছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টর একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করে।তারই অংশ হিসেবে সোসাল মিডিয়া সোলিডারিটি, প্রতিবেদন প্রকাশ ও লাইভ টকশোর আয়োজন করা হয়। গত ২৩ মে  রবিবার সকাল ১১ টায় ঢাকা আহ্ছানয়িা মিশন কর্তৃক আয়োজিত "সড়ক ও নিরাপদ জীবন" শিরোনামে লাইভ আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের এমপি আশ্বস্ত করেন যে ,বর্তমান আইনের উপর যে সকল সুপারিশগুলো দাখিল করা হয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করে আইনের যথাযথ সংশোধন করা হবে।


সড়কের নিরাপত্তা ও সড়কে নিরাপদ জীবন যাপন নিশ্চিত করতে সড়ক আইনের যথাযথ সংশোধন ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।


লেখক:

তোষিকে কাইফু

এডভোকেসী অফিসার (কমিউনিকেশন), রোড সেইফটি প্রকল্প

স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়।


No comments: