![]() |
| একটি অপমৃত্যু ও ৩৫ ঘণ্টা নেটওয়ার্কের বাইরে থাকার গল্প |
— রিয়াজুল নয়ন, সাব-ইনস্পেক্টর, থানচি থানা, বান্দরবান:
একজন পুলিশ সদস্যের কাজ শুধু আইন প্রয়োগ নয়—মানুষের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানো, কঠিন পরিস্থিতিতে নিজের নিরাপত্তার চেয়ে অন্যের জীবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এখানে সেই রকমই এক অভিজ্ঞতার হৃদয়ছোঁয়া বর্ণনা—যেখানে রয়েছে অপমৃত্যুর বেদনা, ৩৫ ঘণ্টা নেটওয়ার্কহীন পাহাড়ি অরণ্য, অন্ধকার নদীপথে লাশ উদ্ধারের সংগ্রাম এবং মানবিক দায়িত্ববোধের এক বিরল উদাহরণ।
নিখোঁজের খবর, তারপর দীর্ঘ অজানা পথের শুরু:
নাপাখুম ঝর্ণায় গোসল করতে গিয়ে এক ব্যক্তি পা পিছলে নিখোঁজ—সংবাদটি আসতেই রেমাক্রির উদ্দেশ্যে রওনা। নৌকা, পাহাড়ি ঝিরি, আঁকা–বাঁকা সরু পথ—থানা থেকে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার কষ্টসাধ্য যাত্রা।
যাত্রার আগেই পরিবারকে জানানো হয়েছিল—“আজ নেটওয়ার্কে থাকবো না।”
কিন্তু ধারণাও ছিলো না, সামনে অপেক্ষা করছে টানা ৩৫ ঘণ্টা নেটওয়ার্কহীন জীবনের গল্প।
অন্ধকার পাহাড়ি পথে দুঃসহ যাত্রা:
রেমাক্রি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা নেমেছে। তারপর বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে নৌকা নিয়ে নাপাখুমের পথে যাত্রা।
পানিস্বল্পতায় বারবার নৌকা পাথরে আটকে যায়—চারবার নৌকা থেকে নেমে কখনো পাহাড়ি রাস্তা, কখনো নদীর ঝিরি ধরে হাঁটা। অন্ধকারে কোথাও কাদায় আটকে কাপড়–চোপড় নষ্ট, আবার কোথাও পিচ্ছিল পাথরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম।
রাত ৭টা ৩০ মিনিটে নাপাখুমের দরজায় পৌঁছালেও শরীরের শক্তি তখন প্রায় নিঃশেষ।
ভয়ংকর নাপাখুম—আরো ভয়ংকর বাস্তবতা:
ঝর্ণার ধারে দাঁড়াতেই মনে হলো—“এখানে কেউ পড়ে গেলে জীবিত ফেরার সম্ভাবনা নেই।”
তারপরও আশায় বুক বেঁধে শুরু হলো অনুসন্ধান।
পরিবারের অনুরোধ—“লাশটা অন্তত খুঁজে দিন, আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিন।”
স্থির সিদ্ধান্ত—যেভাবেই হোক, পরিবারকে হতাশ ফিরতে দেওয়া যাবে না।
রাত্রিবেলা বিভক্ত হয়ে খোঁজ অভিযান:
রাতের অন্ধকারে চারটি দল হয়ে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত নদীপথ অনুসন্ধান—টর্চ আর মোবাইলের আলোই ছিল একমাত্র ভরসা।কিন্তু সেদিন লাশের কোনো সন্ধান মিলল না।স্থানীয় কটেজে অল্প খাবার খেয়ে রাত কাটানোর পর ভোরে আবার খোঁজ শুরু।সব সম্ভাব্য জায়গা খুঁজেও কিছু মিলল না।
সবারই উপলব্ধি—ডুবুরি ছাড়া উদ্ধার অসম্ভব।
এদিকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগহীন অবস্থায়, গাইডদের মাধ্যমে নম্বর লিখে থানায় পাঠানো হলো খবর—“আমাদের ফেরত যেতে দেরি হতে পারে।”
![]() |
| একটি অপমৃত্যু ও ৩৫ ঘণ্টা নেটওয়ার্কের বাইরে থাকার গল্প |
ডুবুরিদের আগমন—আর অপেক্ষার অবসান:
বিকেল হওয়ার আগেই চট্টগ্রাম থেকে এসে পৌঁছাল ডুবুরি দল।খাওয়া–দাওয়ার বিরতি না নিয়ে তারা কাজে নেমে পড়লেন।মাত্র ৩৫ মিনিটের মাথায় খুমের পাথরের ভাজ থেকে লাশ উদ্ধার—চারদিকে ভেসে উঠলো গগনবিদারী কান্না।
অন্ধকার নদীপথে লাশ নিয়ে ফেরার কষ্টসাধ্য যাত্রা:
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে—সময় নষ্টের সুযোগ নেই।
লেখালেখির কাজ শেষ করে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় অন্ধকার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে নৌকা ঘাটে পৌঁছানো। তারপর টর্চের আলোতে নদীপথে রেমাক্রি—সেখান থেকে আবার নৌকা পরিবর্তন করে আড়াই ঘণ্টার যাত্রা শেষে থানায় পৌঁছানো।ঘাটে তখন পরিবারের সদস্যসহ বহু মানুষ অপেক্ষায়।
আইনগত কাজ শেষে লাশ পরিবারের হাতে তুলে দিতে গিয়ে, তাদের চোখের অশ্রু আর সম্মানের ভাষায় যেন সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো।
“আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাকে ভালবাসেন, না হলে এমন একটি ভালো কাজ করার সুযোগ দিতেন না।” — নিজের ভেতরই এ উপলব্ধি।
পরামর্শ—যা সবাইকে জানা উচিত:
-পাহাড়ি নিষিদ্ধ এলাকায় ভ্রমণ করবেন না।
-রোমাঞ্চের চেয়ে নিরাপত্তা অনেক বড়।
-সাঁতার না জানলে এখনই শিখুন।
-জীবনরক্ষার সবচেয়ে জরুরি দক্ষতাগুলোর একটি।
শেষ দৃশ্য—৩৫ ঘণ্টা পর মায়ের ‘আলহামদুলিল্লাহ’
অবশেষে নেটওয়ার্কে ফিরে যখন মাকে ফোন—তিনি শুধু বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ!”
কিন্তু সেই বলে ওঠার আনন্দ–চিৎকার যেন হাজারো দুশ্চিন্তার জমে থাকা ভার একসঙ্গে হালকা করে দিলো।
জানা গেল—টানা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় পরিবার থানায় বারবার ফোন করেছে, উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছে প্রতিটি মুহূর্ত।
এই গল্প দায়িত্ববোধের, মানবিকতার, আর জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসার:
একটি লাশ উদ্ধার অভিযান—যেখানে পাহাড়, অন্ধকার, ঝুঁকি আর কষ্ট পিছিয়ে গেছে একটাই কারণে—একটি পরিবার যেন তাদের প্রিয়জনকে শেষবারের মতো দেখতে পারে।


