৪৫ বছরের লালিত স্বপ্ন জেলা হবে গৌরনদী - সময় সংবাদ | Popular Bangla News Portal

শিরোনাম

Wednesday, August 14, 2019

৪৫ বছরের লালিত স্বপ্ন জেলা হবে গৌরনদী

ডেস্ক খবর-
ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সচেতন বলেখ্যাত এবং বাণিজ্যিক, ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক কারণে বরিশালের গৌরনদীকে জেলা হিসেবে দেখতে চাওয়ার দাবী আজ নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই এই দাবী করা হয়ে আসছে। ১৯৭৪ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ফণীভূষন মজুমদার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বোন জামাতা তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সাথে বরিশাল উত্তর জনপদের একমাত্র মহাকুমা গৌরনদীতে সফরে এসেছিলেন। ওইসময় তিনি (ফণীভূষন মজুমদার) গৌরনদীকে জেলায় উন্নীতকরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে অত্র এলাকার জনগণের দাবীর প্রেক্ষিতে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি গৌরনদীতে এক সমাবেশে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব গৌরনদীকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে একটি জেলা শহরে যেসব অফিস ও অবকাঠামো প্রয়োজন তার অধিকাংশই তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের নেতৃত্বে গৌরনদীতে নির্মান করা হয়। ওই বছরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার বোন জামাতা আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে নির্মমভাবে হত্যার পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টানোর সাথে সাথেই পাল্টে যেতে থাকে অত্র অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য। ফিকে হতে থাকে গৌরনদীকে জেলা হিসেবে দেখার স্বপ্ন।
তার পরেও দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে স্বপ্ন দেখছেন গৌরনদীবাসী। অনেক আগ থেকেই গৌরনদী ছিলো মহকুমা। ১৯৮৪ সালে যখন সব মহকুমাগুলোকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয় তখনও গৌরনদীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকার বরিশাল জেলাকে ভেঙ্গে আরও পাঁচটি জেলাতে ভাগ করলেও গৌরনদীকে মহকুমা থেকে ডিমোশন দিয়ে উপজেলা বানিয়ে রাখা হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘জেলা হবে গৌরনদী’ এমনই আশায় বুক বেঁধে আছেন গৌরনদীবাসী। 
শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্র বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক মন্ত্রী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ সরকারের কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিশ্রুতি ও শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের স্বপ্ন গৌরনদীকে জেলা ঘোষণার জন্য জোর দাবী করেছেন। গত ২২ জুন বাজেটের উপর বক্তৃতা প্রদানের সময়ে তিনি এ দাবী করেছেন। একইসাথে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ বলেন-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনবদ্য ভূমিকায় একসময়ের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সংগঠিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। দক্ষিণাঞ্চলে আরও যেসব উন্নয়ন কাজ দরকার তা উল্লেখ করতে গিয়ে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ প্রথমেই বলেন, গৌরনদীকে জেলায় উন্নীতকরণের জন্য আমি ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত বহুবার মহান সংসদে দাবী উপস্থাপন করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করা হয়নি। গৌরনদীকে জেলা ঘোষনার বিষয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
গৌরনদী জেলার প্রস্তাবিত মানচিত্র ॥ একটি বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার জরিপ সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাাবিত গৌরনদী জেলার অধীনে থাকবে গৌরনদী সদর উপজেলা, আগৈলঝাড়া, মুলাদী, বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, বানারীপাড়া ও কালকিনি উপজেলার একাংশ (কয়ারিয়া, রমজানপুর ও সাহেবরামপুর ইউনিয়ন)। প্রস্তাবিত গৌরনদী জেলার মোট আয়তন হবে ১১৭৭.৮২ বর্গ কিলোমিটার। এরমধ্যে বরিশাল জেলা থেকে আসবে ১১১৪.৫৭ বর্গ কিলোমিটার ও মাদারীপুরের কালকিনি থেকে যোগ হবে ৬৩.২৫ বর্গ কিলোমিটার। গৌরনদী উপজেলার ১৪৪.১৮ বর্গ কিলোমিটার, আগৈলঝাড়া উপজেলা ১৬১.৮২ বর্গ কিলোমিটার, বাবুগঞ্জ থেকে ১৬৪.৮৮ বর্গ কিলোমিটার, মুলাদী থেকে ২৬১.০২ বর্গ কিলোমিটার, উজিরপুর থেকে ২৪৮.৩৫ বর্গ কিলোমিটার, বানারীপাড়া থেকে ১৩৪.৩২ বর্গ কিলোমিটার, কালকিনি থেকে ৬৩.২৫ বর্গ কিলোমিটার। এরমধ্যে কালকিনির কয়ারিয়া ইউনিয়ন থেকে ২০.৮১ বর্গ কিলোমিটার, রমজানপুর ইউনিয়ন থেকে ১৯.৫০ বর্গ কিলোমিটার ও সাহেবরামপুর ইউনিয়ন থেকে ২২.৯৪ বর্গ কিলোমিটার।
প্রস্তাবিত গৌরনদী জেলার আয়তন হবে ১১৭৭.৮২ বর্গ কিলোমিটার। এ আয়তন নিয়েও জেলা গঠণ করা সম্ভব কারণ এই আয়তনের চেয়েও কম আয়তন নিয়ে বাংলাদেশে একাধিক জেলা রয়েছে। এরমধ্যে ঝালকাঠি জেলা ৭৪৯ বর্গ কিলোমিটার, মেহেরপুর জেলা ৫৪৯ বর্গ কিলোমিটার. নারায়ণগঞ্জ জেলা ৭৫৯ বর্গ কিলোমিটার, ফেনী জেলা ৯২৮ বর্গ কিলোমিটার, নড়াইল ৯৯০ বর্গ কিলোমিটার, মাদারীপুর ১১৪৫ বর্গ কিলোমিটার, মুন্সীগঞ্জ ৯৫৫ বর্গ কিলোমিটার, নরসিংদী ১১৪১ বর্গ কিলোমিটার, রাজবাড়ী ১১১৯ বর্গ কিলোমিটার, চুয়াডাঙ্গা ১১৭৭ বর্গ কিলোমিটার, মাগুরা ১০৪৯ বর্গ কিলোমিটার ও জয়পুরহাট জেলার আয়তন মাত্র ৯৬৫ বর্গ কিলোমিটার।
কালকিনি উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন যোগ হবে গৌরনদী সদর উপজেলার সাথে। কালকিনির ওই তিনটি ইউনিয়ন গৌরনদীর সাথে যুক্ত করার পেছনেও রয়েছে বেশ কিছু যৌক্তিক ব্যাখ্যা। এ তিনটি ইউনিয়ন ভৌগলিকগতভাবে মুলাদী ও গৌরনদী উপজেলার মাঝামাঝি অবস্থিত। এসব এলাকার লোকজন কালকিনি বা মাদারীপুরের চেয়ে গৌরনদীর উপরে বেশি নির্ভরশীল। ওই তিনটি ইউনিয়ন কেটে আনা হলে গৌরনদীতে ইউনিয়নের সংখ্যা বেঁড়ে দাঁড়াবে মোট ১০টি। ফলে আয়তন হবে ২০৭.৪৩ বর্গ কিলোমিটার।
সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রস্তাবিত গৌরনদী জেলায় পৌরসভা হবে মোট চারটি। গৌরনদী, উজিরপুর, বানরীপাড়া ও মুলাদী। ইউনিয়ন সংখ্যা হবে মোট ৪৮টি। এরমধ্যে গৌরনদীর সাতটি, আগৈলঝাড়ার পাঁচটি, বাবুগঞ্জের ছয়টি, মুলাদীর সাতটি, উজিরপুরের নয়টি, বানারীপাড়ার ১১টি ও কালকিনির তিনটি। গৌরনদী জেলা হলে বরিশাল বিভাগের জেলা সংখ্যা বেঁড়ে দাঁড়াবে সাতটি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রস্তাবিত গৌরনদী জেলার আসন সংখ্যা হবে তিনটি। গৌরনদী-আগৈলঝাড়া, বাবুগঞ্জ-মুলাদী ও উজিরপুর-বানারীপাড়া)।
গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করণের নানা কারণ ॥ বরিশাল সদর উত্তর মহাকুমা, দক্ষিণাঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ও রাজনৈতিক সচেতন বলেখ্যাত গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করণের লক্ষ্যে জেলা সদরে যেসব অফিস থাকা প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত তা গৌরনদীতে স্থাপন করেছেন। পাঁচ থানা পুলিশের হেডকোয়ার্টার সহকারী পুলিশ সুপারের কার্যালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় অফিস, বন বিভাগের উপ-বিভাগীয় অফিস, বিদ্যুৎ অফিস, বিভাগীয় তাঁত বোর্ড অফিস রয়েছে গৌরনদীতে।
প্রথম উদ্যোগ ॥ ১৯৭৪, ১৯৭৫, ১৯৮১ ও ১৯৯১ সালের পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ নির্বাচিত হন। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর তিনি গৌরনদীকে জেলায় উন্নীত করনের প্রথম পদক্ষেপ স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গৌরনদী পৌরসভা গঠণ করেন। পর্যায়ক্রমে তিনি গৌরনদীকে জেলায় রূপান্তরের লক্ষ্যে গৌরনদীতে ফায়ার সার্ভিস ষ্টেশন, পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিস, ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিভাগীয় বেবী হোমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছেন।
ভৌগলিক অবস্থান ॥ গোপালগঞ্জ জেলার পূর্ব সীমান্তে, মাদারীপুর জেলার দক্ষিণ, বরিশাল বিভাগীয় শহরের উত্তর সীমান্তে ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার মুখে ১৪৪.১৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনে গৌরনদী উপজেলার অবস্থান। বরিশালের বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, মুলাদী, আগৈলঝাড়া ও মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার মধ্যবর্তীস্থানে গৌরনদী অবস্থিত। অতি প্রাচীণকাল থেকেই শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, ইতিহাস-ঐতিহ্যে গৌরনদীর সুনাম-সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পরে। এখনও তা বিদ্যামান রয়েছে। এখানে গড়ে উঠেছিলো উন্নত জনপদ। তাই মোগল যুগে ইসলাম প্রচারক খানজাহান আলী ও ইয়েমেনের বাদশার পুত্র হযরত মল্লিক দূত কুমার পীর সাহেব বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে এসে গৌরনদীতে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা এ অঞ্চলে স্থাপন করেছেন বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, দীঘি ও সরাইখানা। এখানে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী আল্লাহর মসজিদ, কমলাপুর মসজিদ, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান বার্থী তাঁরা মায়ের কালী মন্দির, মাহিলাড়ার সরকার মঠ, সমাজ সেবক ছবি খাঁর হুজরা, পলাশীর যুদ্ধের দূর্গ ও কামান, শতিদাহ মঠসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন।
সূত্রে আরও জানা গেছে, দেশের সব মহাকুমাগুলো ইতোমধ্যে জেলা হয়ে গেলেও অবহেলিত রয়ে গেছে শুধুমাত্র গৌরনদী মহাকুমা। তাই গৌরনদীকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র হাত ধরে বাস্তবায়ন করা হবে সেই আশায় বুক বেঁধে আছেন গৌরনদীবাসী।

No comments: