![]() |
| আমি তো টিকিট কাইটটাই উঠছিলাম, ৫০ টাকা লস -শিশু ইয়াসিন |
মো: নাজমুল হোসেন ইমন, স্টাফ রিপোর্টার:
শহরের বুকে ছুটে চলা ঝকঝকে মেট্রোরেল আধুনিকতার প্রতীক হলেও সেই আধুনিকতার ভেতরেও লুকিয়ে আছে কঠিন বাস্তবতা। সেই বাস্তবতার কেন্দ্রেই দাঁড়িয়ে ১২-১৩ বছরের পথশিশু ইয়াসিন। ধুলোমাখা পোশাক, কিন্তু পকেটে জমা পরিশ্রমের ৫০ টাকা—সারাদিন ভিক্ষা করে জমানো মূল্যবান নোট।
টিকিট কাউন্টারে দাঁড়িয়েও সাহস পাচ্ছিল না সে। পরে এক অপরিচিত যাত্রীকে অনুরোধ করে টিকিট কাটিয়ে নেয়। মনে মনে ভেবেছিল—আজ সে ‘ফকির’ নয়, সে যাত্রী। নিয়ম মেনেই ট্রেনে উঠবে।
কিন্তু ট্রেনের দরজা খুলতেই সামনে ভেসে আসে ঠাসাঠাসি ভিড়। দম বন্ধ হয়ে আসে ইয়াসিনের। সে অভ্যস্ত খোলা আকাশের নিচে লোকাল ট্রেনের ছাদে দাঁড়ানোর আজাদি বাতাসে। কেউ একজন ধমক দিয়ে সরতে বললে আরও অস্বস্তিতে পড়ে সে।
হঠাৎ চোখে পড়ে দুই বগির মাঝের সংযোগস্থলের শক্ত গ্রিল। মনে পড়ে তার ভাই ইমনের ‘ট্রেনিং’—চলন্ত ট্রেনে কায়দা করে ওঠা-নামার কৌশল। ভাবল, “মেট্রো আর কত কী! আমার তো ট্রেনিং আছে।” তারপর ভিড় ঠেলে বেরিয়ে গ্রিল ধরে ঝুলে পড়ে। বাতাস মুখে লাগতেই সে হাসে। সে জানে না, তার মাথার ঠিক ওপরেই রয়েছে ১৫০০ ভোল্টের মৃত্যুফাঁদ।
পরের স্টেশনেই তাকে ধরে ফেলে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। সবার চোখে উদ্বেগ, কিন্তু ইয়াসিনের চোখে কেবল বিস্ময়।
এক অফিসার জিজ্ঞেস করেন,“তুমি জানো, তুমি মরে যেতে পারতে?” ইয়াসিন নির্বিকারভাবে জবাব দেয়—“মরতাম না স্যার, আমার ট্রেনিং আছে।”
অফিসার জানতে চাইলে কার কাছ থেকে ট্রেনিং, গর্ব করে বলে—“আমার ভাই ইমন। হেয় বড় ডাকাত। হেয় শিখাইছে।”
পুলিশ ভয় দেখিয়ে বলে তাকে আটকানো হবে, ডান্ডাবেরি পরানো হবে। কিন্তু ইয়াসিন হাসে। তার যুক্তি—“আটকাইলে আটকান। কাম করুম, খামু, ঘুমামু—এইডাই তো আমার কাম।”
সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। যার কাছে জেলখানা ‘খাওয়া-ঘুমানোর জায়গা’, তাকে ভয় দেখাবেন কী দিয়ে? মা নেই, বাবা নেই, ঠিকানা বলতে তার পরিচয় শুধু পথ।
পুলিশ যখন তাকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন ইয়াসিনের একমাত্র আফসোস— “আমি তো টিকিট কাইটটাই উঠছিলাম... ৫০ টাকা লস!”
প্রযুক্তির অগ্রগতির পাশাপাশি মানুষের সচেতনতা, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা না বাড়ালে আধুনিকতার সুফল সবাই পাবে না। চকচকে মেট্রোরেলের নিচে যে কঠিন বাস্তবতা লুকিয়ে আছে—ইয়াসিনের ঘটনাটি তা স্পষ্ট করে তুলে ধরে।

