জেলা প্রতিনিধিঃ
ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারের মাঝেও ব্যস্ত একদল মানুষ। রাতের শেষ ভাগ, ভোর হতে বাকি ঘণ্টাখানেক। প্রত্যন্ত গ্রামে নীরব নিস্তব্ধ পুরো অঞ্চল। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে চোরাকারবারিরা।
মাঝারি সাইজের একটি হলুদ রঙের ট্রাকে তোলা হচ্ছে বড় বড় বস্তা। বস্তার ভেতরেও রয়েছে বেশকিছু কাটুন। স্থানীয় কিছু সহায়তায় মাল তোলা হচ্ছে গাড়িতে। মালগুলোকে আবার ঢেকে রাখা হয়েছে ত্রিপল দিয়ে। মোটা রশিতে মাল গুলোকে এপাশ ওপাশ করে বাঁধা হয়েছে শক্ত করে। অনেক তাড়াহুড়া করেই যেন করা হচ্ছে কাজ। সামান্য বাতাসের শব্দ যেন সতর্ক হয়ে যায় তারা। চোরাকারবারিরা অবৈধ পথে ভারত থেকে আনা লক্ষাধিক টাকার কসমেটিকস এভাবেই রাতের আঁধারে নিয়ে যান নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
এরই মাঝে স্থানীয় এক ব্যক্তি রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে উঠে চোরাকারবারীদের এ দৃশ্য দেখে তাৎক্ষণিক মোবাইল ফোনে বিষয়টি জানান প্রশাসন ও স্থানীয় সাংবাদিকদের। সুনির্দিষ্ট সংবাদ পাওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই ঘটনাস্থলে হাজির হন পুলিশ ও সাংবাদিকরা। তবে তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে মুহূর্তেই অনেকটা অন্ধকারে মিলিয়ে যায় চোরাকারবারি ও গাড়িচালক। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় ট্রাকভর্তি বিপুল পরিমাণ ভারতীয় কসমেটিকস।
এভাবেই দিনের পর দিন অবৈধ পথে ভারত থেকে আমদানি করা লাখ লাখ টাকার কসমেটিকস রাতের আঁধারে সীমানার কাঁটা তারের বেড়া পার করে ঢুকছে নেত্রকোনার দুর্গাপুরে।
আবার রাতের মধ্যেই গাড়িতে ভরে এসব অবৈধ পণ্য চলে যাচ্ছে রাজধানী শহর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মাঝে মধ্যে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি ও পুলিশের হাতে নামমাত্র কিছু পণ্য ধরা পড়লেও বড় একটি অংশ চলে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
শুক্রবার ভোরে উপজেলার চন্ডিগড় ইউনিয়নের ফেচিয়া গ্রামে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয় পুলিশ ও স্থানীয় সাংবাদিকরা। অভিযানে আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ ভারতীয় মালামালসহ ট্রাকটিকে আটক করা হয়।
পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আগেই ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় ট্রাকচালকসহ অন্যান্য চোরাকারবারিরা। তবে তাদের আটক করতে না পারলেও আতিকুল ইসলাম নামে এক শ্রমিককে ঘটনাস্থল থেকে আটক করে পুলিশ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা সীমান্ত দিয়ে কিছু চোরাকারবারি বিপুল পরিমাণ ভারতীয় কসমেটিক, সাবান, চকলেটসহ বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশ নিয়ে আসেন। পরে রাতেই ফেচিয়া টাঙ্গাই নদীর ব্রীজের উপর ট্রাক দাঁড় করিয়ে মালামালগুলো গাড়িতে তুলে নেয় চোরাকারবারি। এসময় স্থানীয়রা ঘটনাটি বুঝতে পেরে প্রশাসনকে খবর দিলে ভোররাতে পুলিশ ঘটনাস্থলে অভিযান চালায়। অভিযানে ট্রাক ও মালামাল জব্দ করে দূর্গাপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে জব্দকৃত মালামালের বাজার মূল্য প্রায় ১০ লক্ষ টাকার উপরে।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা যায়, গত দুই বছর ধরে উপজেলার চন্ডিগড় ইউনিয়নের ফেচিয়াসহ চিহ্নিত বেশকিছু গ্রাম দিয়ে স্থানীয় চোরাকারবারিরা ভারত থেকে গরু নিয়ে আসছেন। তবে মহামারি করোনা সংকটের কারণে সীমান্তে গরু চোরাচালান বন্ধ থাকার কারণে এখন গরু চোরাকারবারিরা কসমেটিকসের ব্যবসায় নেমেছেন। প্রায় প্রতিদিনই এইসব এলাকা থেকে একটি বা তারও বেশি গাড়িতে করে কসমেটিকস চলে যাচ্ছে ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন স্থানে। বিশেষ করে মধ্যরাত দিকেই গাড়িগুলো সীমান্ত এ এলাকা অতিক্রম করে। বিগত এক বছরে ফেচিয়া ছাড়াও চন্ডিগড় এর বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালিয়ে ভারতীয় গরু আটক করে পুলিশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, উপজেলার সদর ইউনিয়ন ও চন্ডিগড় ইউনিয়নের বেশকিছু গ্রাম ভারতের সীমান্তবর্তী হয় এখানকার অনেকেই চোরাকারবারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আগে বেশিরভাগ মানুষ গরুর ব্যবসা করলেও এখন তা বন্ধ থাকায় কসমেটিকসের দিকে ঝুঁকছেন অনেকেই। একটি প্রত্যন্ত গ্রাম তার উপর রাত হলেই নিরাপদ স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো গ্রাম। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সুবিধাভোগী কিছু ব্যক্তি কাজগুলো করে আসছে। এতে করে একদিকে যেমন লোকসানের মুখে পড়েছেন দেশের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তেমনি বৃহৎ একটি অংশ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের সরকার। এসব চোরাচালান বন্ধে অচিরেই সীমান্ত এলাকায় সীমান্ত হাট করার পাশাপাশি স্থলবন্দর চালু করার জোর দাবি জানান তিনি।
এ ব্যাপারে দুর্গাপুর থানার ওসি শাহ্ নুর এ আলম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে এবং একজনকে আটক করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাকে কোর্টে সোপর্দ করা হয়েছে। মালামালের সিজারলিস্ট করা হয়েছে।
