![]() |
| বিলাসবহুল অতিথিশালা এখন কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের গলারকাঁটা |
মো: নাজমুল হোসেন (ইমন), স্টাফ রিপোর্টার:
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম সাবমেরিন টানেল ‘কর্ণফুলী টানেল’ উদ্বোধনের এক বছর না যেতেই প্রকল্পটি ঘিরে উঠেছে নানা বিতর্ক। প্রকল্প ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিলাসবহুল অতিথিশালা নির্মাণ এবং টানেল ব্যবহার কম হওয়ায় জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে টানেলটি উদ্বোধনের সময় এটি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের এক ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে প্রশংসিত হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি এখন অনেকের কাছে ‘বিলাসী রাজনৈতিক প্রকল্প’ ও অর্থনৈতিক বোঝা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
তথ্যসূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের আওতায় ৪৫০ কোটি টাকায় একটি বিলাসবহুল অতিথিশালা নির্মাণ করা হয়। চট্টগ্রামের আনোয়ারা প্রান্তের পারকি খালের পাশে অবস্থিত এই স্থাপনাটিতে রয়েছে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ছয়টি কক্ষ, একটি সুইমিং পুল এবং উন্নতমানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
এটি মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য সফর উপলক্ষে তৈরি করা হয়েছিল। তবে উদ্বোধনের পর থেকে অতিথিশালাটি একদিনও ব্যবহার করা হয়নি। সেতু বিভাগ জানিয়েছে, অতিথিশালাটি সচল রাখার মতো পর্যাপ্ত জনবল নেই।
প্রকল্পের আওতায় আরও একটি সার্ভিস এরিয়া গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে রয়েছে ৩০টি বিশ্রামাগার, সম্মেলনকেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মসজিদ, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটি জাদুঘর।
অন্যদিকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরত্বে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ৭৯ কোটি টাকায় একটি আধুনিক পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ করছে। এতে অতিথিশালার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আরও প্রশ্ন উঠেছে।
টানেল চালুর পর প্রথম মাসে দৈনিক গড়ে মাত্র ৩,৫০০ যানবাহন চলাচল করেছে—যেখানে প্রকল্প সমীক্ষায় উল্লেখ ছিল দৈনিক ২০,০০০ যানবাহনের। বর্তমানে মাসিক গড়ে আড়াই কোটি টাকা টোল আদায় হচ্ছে, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা। ফলে প্রতি মাসে ৯ কোটিরও বেশি টাকার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় নির্ধারণ ছিল ৮,৪৪৬ কোটি টাকা, কিন্তু জমি অধিগ্রহণ ও অতিরিক্ত অবকাঠামোগত ব্যয়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০,৬৮৯ কোটি টাকায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন,“এই প্রকল্পে অতিথিশালা নির্মাণের কোনো প্রয়োজন ছিল না। এটি একটি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এবং দুর্নীতির দৃষ্টান্ত।”
ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহাইব মন্তব্য করেন, “প্রকল্পের শুরুতেই অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছিলেন, এটি ‘সাদা হাতি’ হয়ে যাবে—এখন তাই প্রমাণিত হচ্ছে।”
সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, “এই প্রকল্পের আর্থিক সংকট সরকারের জন্য শিক্ষা হওয়া উচিত। ভবিষ্যতে অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের আগে এর যৌক্তিকতা যাচাই জরুরি।”
চট্টগ্রাম নগরকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কক্সবাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের যাত্রা শুরু হলেও এখন তা সরকারের জন্য আর্থিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে টানেলটির পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে, এর আয় দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের এক-চতুর্থাংশও পূরণ হবে না।

