খেজুরের যত গুণ ও উপকারিতা - সময় সংবাদ | Popular Bangla News Portal

Breaking

Post Top Ad

Responsive Ads Here

বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ২৩, ২০২৫

খেজুরের যত গুণ ও উপকারিতা

খেজুরের যত গুণ ও উপকারিতা
খেজুরের যত গুণ ও উপকারিতা



তৌফিক সুলতান:

খেজুর পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও পুষ্টিকর ফল। এটি শুধু একটি সাধারণ খাদ্য নয়, বরং শক্তি, স্বাস্থ্য ও বরকতের এক জীবন্ত প্রতীক। হাজার বছরের মানবসভ্যতার ইতিহাসে খেজুর তার অনন্য স্থান ধরে রেখেছে। মরুভূমির বালুকায় অল্প পানিতে, তীব্র রোদে ও কঠিন পরিবেশেও খেজুরগাছ টিকে থাকে—জীবন দেয়, ছায়া দেয়, ফল দেয়। ঠিক তেমনি মানবজীবনের প্রতীক হয়ে খেজুর আজও ধৈর্য, সহনশীলতা ও আশার বার্তা বহন করে।


খেজুরের বৈজ্ঞানিক নাম Phoenix dactylifera।  এটি পাম গাছ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় চাষ হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ খেজুরকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, পারস্য ও মিশরীয় সভ্যতায় এটি ছিল পবিত্র ফল। এমনকি ফেরাউনের কবরেও খেজুর রাখা হতো, কারণ তারা বিশ্বাস করত—মৃত্যুর পরের জীবনে এটি আত্মাকে শক্তি দেবে।


🌙 ইসলামে খেজুরের মর্যাদা:

ইসলামের ইতিহাসে খেজুরের স্থান অনন্য। সূরা মারইয়াম–এ বর্ণিত আছে, নবী ঈসা (আ.)–এর মা মরিয়ম যখন সন্তান জন্মদানের যন্ত্রণায় ছিলেন, তখন আল্লাহ তাঁকে খেজুরগাছ নাড়াতে বলেন, যাতে পাকা খেজুর পড়ে। মরিয়ম সেই খেজুর খেয়ে শক্তি পান ও নবজাতক সন্তান প্রসব করেন। এটি প্রমাণ করে, খেজুরে রয়েছে প্রাকৃতিক শক্তি যা শারীরিক দুর্বলতা দূর করে ও প্রসব সহজ করে।


রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনেও খেজুরের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি নিয়মিত খেজুর খেতেন এবং সাহাবিদেরও খেতে উৎসাহ দিতেন। তিনি বলেছেন, “তোমরা রোজা ভাঙো খেজুর দিয়ে, যদি তা না পাও তবে পানি দিয়ে।” (তিরমিজি)। আবার হাদীসে এসেছে, “যে ব্যক্তি সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে, সেদিন তার ওপর কোনো বিষ বা জাদুর প্রভাব পড়বে না।” (বুখারি)। এসব বাণী প্রমাণ করে, খেজুর কেবল পুষ্টিকর নয়—এটি আত্মিক ও শারীরিক সুরক্ষার প্রতীকও বটে।


খেজুরের যত গুণ ও উপকারিতা
খেজুরের যত গুণ ও উপকারিতা



🧬 খেজুরের পুষ্টিগুণ:

প্রতি ১০০ গ্রাম খেজুরে থাকে প্রায় ২৭৭ ক্যালোরি শক্তি, ৭৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৭ গ্রাম ফাইবার, ২ গ্রাম প্রোটিন, ৬৪ মি.গ্রা. ক্যালসিয়াম, ৫৪ মি.গ্রা. ম্যাগনেসিয়াম, ১ মি.গ্রা. আয়রন ও ৬৯৬ মি.গ্রা. পটাশিয়াম। এছাড়া এতে রয়েছে ভিটামিন বি৬, ভিটামিন কে, ফলেট ও প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—খেজুরে কোনো কোলেস্টেরল বা ট্রান্স ফ্যাট নেই। ফলে এটি হৃদরোগী ও ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য সীমিত পরিমাণে নিরাপদ ও উপকারী।


খেজুরে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড, ক্যারোটিনয়েড ও ফেনোলিক অ্যাসিড কোষের ক্ষয় প্রতিরোধ করে, ক্যান্সার ও বার্ধক্য বিলম্বিত করে। অন্যদিকে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম হৃদযন্ত্রকে সক্রিয় রাখে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, আর আয়রন ও ফলেট রক্তে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করে।


💪 উপবাস ও শক্তির প্রাকৃতিক উৎস:

দীর্ঘ সময় উপবাস থাকার পর খেজুর শরীরে গ্লুকোজ সরবরাহ করে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় করে তোলে। তাই মুসলমানরা ইফতারে প্রথমেই খেজুর খান—এটি কেবল ধর্মীয় অনুশাসন নয়, বরং বৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্যনীতি।


❤️ হৃদরোগ ও রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে:

নিয়মিত খেজুর খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। এতে থাকা পটাশিয়াম হৃদপিণ্ডের ছন্দ ঠিক রাখে, রক্তনালিকে মজবুত করে, আর ফ্ল্যাভোনয়েড কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে। আয়রন ও ফলেট রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরি করে রক্তশূন্যতা দূর করে।


বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, শিশু ও বয়স্কদের জন্য খেজুর অত্যন্ত উপকারী। প্রতিদিন তিন–চারটি খেজুর খেলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, ত্বক উজ্জ্বল হয় ও মনোযোগ বাড়ে।


🍽️ হজম ও অন্ত্রের স্বাস্থ্য:

খেজুরে থাকা ফাইবার অন্ত্রের গতিশীলতা বাড়ায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত খেজুর খেলে অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ে, যা হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে।


🧠 মানসিক ও যৌন স্বাস্থ্য:

খেজুরে থাকা পলিফেনল মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি উন্নত করে, ঘুমে সহায়তা করে ও মানসিক চাপ কমায়। এতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম ও ট্রিপটোফ্যান শরীরে সেরোটোনিন উৎপন্ন করে, যা বিষণ্নতা প্রতিরোধ করে।

যৌন স্বাস্থ্যেও খেজুর কার্যকর—এটি প্রাকৃতিক অ্যাফ্রোডিসিয়াক হিসেবে কাজ করে। খেজুর দুধে ভিজিয়ে খেলে পুরুষদের সহনশক্তি ও শুক্রাণুর মান বৃদ্ধি করে এবং নারীদের হরমোন ভারসাম্য রক্ষা করে।


🧒 গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্য:

খেজুর গর্ভাবস্থায় জরায়ুর পেশি শক্ত করে, প্রসব সহজ করে এবং রক্তক্ষয় কমায়। এতে থাকা ফোলেট শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করে। শিশুদের জন্য এটি প্রাকৃতিক মাল্টিভিটামিন—খেজুরের রস দুধ বা পায়েসে মিশিয়ে খাওয়ালে শক্তি ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।


খেজুরের যত গুণ ও উপকারিতা
খেজুরের যত গুণ ও উপকারিতা



🌍 বিশ্বজুড়ে খেজুর শিল্প:

বিশ্বে প্রায় তিন শতাধিক প্রজাতির খেজুর রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত আজওয়া খেজুর, যা মদিনার ফল এবং হাদীসে এর বিশেষ ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া মাবরুম, সুক্কারী, সাফাওয়ি, মেজুল ও ডেগলেট নুরও জনপ্রিয়।

বর্তমানে সৌদি আরব, ইরান, মিশর, ওমান, আলজেরিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ৪০টিরও বেশি দেশে বাণিজ্যিকভাবে খেজুর উৎপাদিত হয়। বছরে প্রায় নয় মিলিয়ন টন খেজুর উৎপন্ন হয়, যার বাজারমূল্য বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।


বাংলাদেশেও খেজুর একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। বিশেষত যশোর, রাজশাহী, সাতক্ষীরা ও বরিশাল অঞ্চলে খেজুরগাছের রস থেকে গুড় ও পাটালি তৈরি হয়, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।


🧴 সংরক্ষণ ও সতর্কতা:

খেজুর সংরক্ষণের সময় আর্দ্রতা এড়িয়ে চলা জরুরি। আর্দ্র পরিবেশে ছত্রাক জন্মাতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই খেজুর সবসময় শুকনো ও ঠান্ডা স্থানে রাখা উচিত। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে দিনে দুই–তিনটির বেশি খাওয়া ঠিক নয়, কারণ এতে প্রাকৃতিক চিনি থাকলেও অতিরিক্ত খেলে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যেতে পারে।


🌿 খেজুর—জীবনের মিষ্টতা ও সহনশীলতার প্রতীক:

খেজুর শুধু একটি ফল নয়, এটি প্রকৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান ও মানবজীবনের প্রতিটি দিকের প্রতিফলন। মরুভূমিতে যেমন খেজুরগাছ অল্প পানিতে টিকে থাকে, তেমনি মানুষও সীমিত উপকরণে বড় কিছু অর্জনের শিক্ষা পায়।


আরব কবিদের ভাষায়—“যেমন খেজুরগাছ শুকনো বালিতে শিকড় ছড়িয়ে আকাশ ছোঁয়, তেমনি মানুষও কষ্ট সহ্য করে উন্নতির শিখরে পৌঁছায়।”


খেজুর আমাদের শেখায় সহনশীলতা, দানশীলতা ও ধৈর্যের পাঠ। নবীর প্রিয় ফল হিসেবে এটি শরীর, মন ও আত্মার পুষ্টি জোগায়। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় কয়েকটি খেজুর রাখলে শরীর পায় পুষ্টি, মন পায় প্রশান্তি, আর আত্মা পায় বরকত।


সত্যিই—খেজুর কেবল একটি ফল নয়, এটি জীবনের মিষ্টতা ও সুস্থতার প্রতীক।



Post Top Ad

Responsive Ads Here