![]() |
শেয়ারবাজারের দুর্বল ভূমিকা শিল্পায়নের পথে বড় বাধা |
মো: নাজমুল হোসেন ইমন, স্টাফ রিপোর্টার:
বিশ্বজুড়ে শিল্পায়নের অন্যতম প্রধান উৎস হলো শেয়ারবাজার। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এই বাজারের অবদান সীমিত। দেশের উদ্যোক্তারা ব্যাংকনির্ভর হওয়ায় মূলধন বাজার রয়ে গেছে উপেক্ষিত অবস্থায়। ফলে শিল্পায়নের গতি যেমন মন্থর, তেমনি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও কমছে দিন দিন।
ব্যাংকনির্ভর অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের সীমাবদ্ধতা:
বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এখনো ব্যাংক ঋণনির্ভর ব্যবসা পরিচালনায় আগ্রহী। শেয়ারবাজারে মূলধন সংগ্রহের উদ্যোগ খুবই সীমিত। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্ম নিবন্ধন পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি রয়েছে ৩,৭৭৭টি, কিন্তু তালিকাভুক্ত কোম্পানি মাত্র ৩৯৭টি। অর্থাৎ, নিবন্ধিত কোম্পানির ৯০ শতাংশেরও বেশি শেয়ারবাজারের বাইরে রয়ে গেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ৪৩৩টি, এর মধ্যে ৩৯৭টি কোম্পানি এবং ৩৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড। কিন্তু এসব কোম্পানির বড় অংশই আর্থিকভাবে দুর্বল, যা বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মুখে ফেলছে।
আর্থিক দুর্বলতা ও বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি:
ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ‘এ’ গ্রুপে রয়েছে ২১৯টি, ‘বি’ গ্রুপে ৮১টি এবং ‘জেড’ গ্রুপে ৯৭টি প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ, প্রায় ২৪ শতাংশ কোম্পানি নিয়মিত লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ। কিছু কোম্পানি বছরের পর বছর কোনো লভ্যাংশ না দিয়েও টিকে আছে।
এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা দিন দিন কমছে। তাছাড়া, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলো (যেমন ফ্লোর প্রাইস) বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আইপিও খরা: নতুন বিনিয়োগ নেই:
প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) সাধারণত শেয়ারবাজারে নতুন রক্ত হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু ২০২৪ সালের জুনের পর থেকে কোনো কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে অর্থ তুলেনি।এখন পর্যন্ত প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাজারে নতুন কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি। আগের বছরগুলোতে গড়ে প্রতি বছর ৮–১৫টি কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে বাজারে আসত।এই স্থবিরতা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের নতুন প্রবাহকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে।
বাজারের নিম্নগতি ও আস্থার সংকট:
২০২২ সালে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের পর বাজারে লেনদেন হঠাৎ কমে যায়। দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেন নেমে আসে ২০০–৬০০ কোটি টাকায়।২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর কিছু সংস্কার শুরু হলেও বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুরোপুরি ফিরেনি।২০২৫ সালের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডিএসইএক্স সূচক ৫,৫৯৪ পয়েন্ট থেকে নেমে ৫,৪১৫ পয়েন্টে এসেছে—অর্থাৎ এক মাসে ১৭৯ পয়েন্ট পতন। বাজারমূলধনও কমেছে প্রায় ২,০৮৫ কোটি টাকা।
বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহ:
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার ছাড়তে শুরু করেন।২০২৩ সালের অক্টোবরে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব ছিল ৫৫,৫১২টি; বর্তমানে তা কমে ৪৩,৮০১টিতে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, এক বছরে ১১,৭১১টি হিসাব বন্ধ হয়েছে।এ ছাড়া স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও অনেকেই বাজার ছাড়ছেন। ২০১৯ সালে দেশে বিও হিসাব ছিল প্রায় ২৮ লাখ ৪৫ হাজার, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৫২ হাজার—ছয় বছরে অর্ধেকে নেমে এসেছে এই সংখ্যা।
ব্যাংক খাত ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডেও ধস:
একসময় শেয়ারবাজারে ব্যাংক খাত ছিল প্রধান চালিকা শক্তি। এখন এই খাতও দুর্বল।তালিকাভুক্ত ৩৬টি ব্যাংকের মধ্যে ১৭টির শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের নিচে, আর ৭টি ব্যাংকের শেয়ার ৫ টাকারও নিচে নেমে গেছে।অন্যদিকে, ৩৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩৩টির দাম ফেস ভ্যালুর নিচে, এবং ২০টির দাম ৫ টাকার নিচে। ফলে, এই খাতেও বিনিয়োগকারীরা বড় ক্ষতির মুখে।
অর্থনীতিতে প্রভাব ও ভবিষ্যৎ করণীয়:
অর্থনীতিবিদদের মতে, শক্তিশালী পুঁজিবাজার ছাড়া টেকসই শিল্পায়ন সম্ভব নয়।শিল্পোদ্যোগ, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে দীর্ঘমেয়াদি মূলধন প্রয়োজন, যা ব্যাংকনির্ভর অর্থায়নে সম্ভব নয়।তাদের পরামর্শ, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা, নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি কর প্রণোদনা দিতে হবে মূলধন বাজারে।
বাংলাদেশের শিল্পায়নের গতি মূলধন ঘাটতির কারণে ধীর হয়ে আছে।যদি শেয়ারবাজারকে কার্যকর ও স্বচ্ছ করা যায়, তবে তা শুধু বিনিয়োগ বাড়াবে না—অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তরেও বড় ভূমিকা রাখবে।অন্যথায়, ব্যাংকনির্ভর এই অর্থনীতি আগামী দিনেও শিল্পোন্নয়নের গতি বাধাগ্রস্ত করবে।