রেকর্ড খেলাপিতে নাজুক ব্যাংক খাত
মো: নাজমুল হোসেন ইমন, স্টাফ রিপোর্টার:
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণে এখন মারাত্মক সংকটে পড়েছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর বেরিয়ে আসছে ব্যাংক খাতের গোপন বাস্তবতা। সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ শতাংশ।
২০২৫ সালের জুন শেষে দেশের মোট ব্যাংকঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ লাখ ৪৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এই অঙ্ক বেড়েছে ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা—যা ২০২৪ সালের জুনে ছিল মাত্র ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। বিশ্লেষকদের মতে, এক বছরের মধ্যে তিনগুণ বৃদ্ধি ব্যাংক খাতের জন্য ‘উদ্বেগজনক সংকেত’।
ঋণখেলাপি বাড়তে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে পাঁচটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত (মার্জার) করার উদ্যোগ চূড়ান্ত করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই লাগামহীন ঋণখেলাপি ব্যাংকগুলোকে তারল্য সংকটে ফেলছে, ফলে নতুন ঋণ বিতরণেও দেখা দিচ্ছে জটিলতা।
ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ায় ব্যবসায়ীরা এখন উচ্চ সুদের চাপের মুখে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা পার পেলেও প্রকৃত উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। এতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমছে, আমানতকারীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হঠাৎ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে তিনটি বড় কারণ রয়েছে—
১. হাসিনা আমলে নাম–বেনামে দেওয়া ঋণগুলো এখন প্রকাশ পাচ্ছে।
২.আইএমএফের শর্তে খেলাপি ঘোষণার সময়সীমা ৬ মাস থেকে ৩ মাসে নামানো হয়েছে।
৩. কৃষি ও এসএমই খাতে বিশেষ সুবিধা বাতিল হওয়ায় খেলাপির সংখ্যা বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, খেলাপি ঋণের বর্তমান অঙ্ক দেশের জিডিপির একটি বড় অংশের সমান। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।২০০৯ সালে মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, যা বর্তমানে ৩০ গুণের বেশি বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন—“৫ আগস্টের পরে অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে, যেগুলো এখন খেলাপি হয়েছে। আগে আদালতের বিশেষ সুবিধায় খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানো যেত, এখন তা বন্ধ। আইএমএফের শর্তও খেলাপি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। তাই যেকোনোভাবে ঋণ আদায় প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে।”
বিআইবিএমের গবেষণা পরিচালক ড. শাহ মো. আহসান হাবিব বলেন—“ঋণখেলাপি আমাদের ব্যাংক খাতের সবচেয়ে জটিল সমস্যা। এত দিন এটি আড়ালে রাখা হয়েছিল। এখন বাস্তব চিত্র প্রকাশ করা সরকারের সাহসী পদক্ষেপ। সমস্যা স্বীকার করলেই সমাধানের পথ তৈরি হয়।”
তিনি আরো বলেন, “লুকানো খেলাপি ও পলাতক গ্রাহকদের ঋণ আলাদা করে দেখা দরকার। যাদের ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি, তাদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। প্রয়োজনে নেপালের মতো খেলাপিদের নাম প্রকাশ করে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ করতে হবে।”
সূত্র জানায়, বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর প্রভাবমুক্ত হওয়ার পর ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক—এই ছয় ব্যাংকে ঋণখেলাপি বাড়ছে দ্রুত হারে।
খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা এখন এমন পর্যায়ে, যেখানে অনেক ব্যাংক নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছে। এর ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমছে, কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে, এবং সরকারও কর রাজস্ব হারাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা হারাবে সাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এখন এক ‘সংক্রমণ পর্যায়’-এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গোপন ঋণ ও রাজনৈতিক প্রভাবে সৃষ্ট খেলাপির বাস্তব চিত্র প্রকাশ পাওয়ায় সাময়িকভাবে চাপ বাড়লেও এটি ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ হতে পারে—এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।