![]() |
| দখল-দূষণে মৃত্যুপথযাত্রী বুড়িগঙ্গা নদী |
মো: নাজমুল হোসেন ইমন, স্টাফ রিপোর্টার:
রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা ঐতিহ্যবাহী বুড়িগঙ্গা নদী দীর্ঘদিন ধরেই দূষণে জর্জরিত। নদীটির এই করুণ অবস্থা যেন বছরের পর বছর চলমান দুঃখের গল্প। বর্ষায় পানির পরিমাণ বাড়লেও দূষণ কমে না বললেই চলে, আর শুষ্ক মৌসুমে নদী থেকে ভয়াবহ দুর্গন্ধ ছড়ায়।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায় বুড়িগঙ্গার ঋতুভিত্তিক দূষণের স্পষ্ট চিত্র উঠে এসেছে। ২০২২-২৩ সালে ছয় মৌসুম ও ১২ মাস ধরে নদীর আটটি স্থানের ১০টি মানদণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হয়।
উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় মিরপুর ব্রিজ, বছিলা ব্রিজ, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীর চর, চাঁদনীঘাট, সদরঘাট, ধোলাইখাল ও পোস্তগোলা ব্রিজ থেকে। মানদণ্ডগুলোর মধ্যে ছিল দ্রবীভূত অক্সিজেন, জৈব রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা (বিওডি), দৃশ্যমানতা, বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা, তাপমাত্রা, পিএইচ, ঘোলাটে ভাব, ক্ষারত্ব, অদ্রবণীয় ক্ষুদ্র কঠিন পদার্থ (টিএসএস) এবং মোট দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ (টিডিএস)।
জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য পানিতে প্রতি লিটারে ন্যূনতম পাঁচ মিলিগ্রাম অক্সিজেন প্রয়োজন। কিন্তু ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার গড় অক্সিজেনের মাত্রা ৩.০১ মিলিগ্রাম/লিটার। শুধু বর্ষা (৬.৫৫ মিলিগ্রাম) ও শরৎকালে (৬ মিলিগ্রাম) প্রয়োজনীয় মাত্রা পাওয়া গেছে। শীতকালে সবচেয়ে কম—মাত্র ০.৬৩ মিলিগ্রাম।
পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ২০২৩ অনুযায়ী, মৎস্য চাষের জন্য বিওডি সীমা সর্বোচ্চ ৬ মিলিগ্রাম/লিটার এবং পরিশোধিত বর্জ্যের ক্ষেত্রে ৩০ মিলিগ্রাম। অথচ বুড়িগঙ্গায় গড় বিওডি পাওয়া গেছে ১০৭.৯৪ মিলিগ্রাম, যা সহনীয় মাত্রার প্রায় ১৮ গুণ বেশি। বসন্তকালে এ মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ২১৭.৫০ মিলিগ্রামে—সীমার ৩৬ গুণ বেশি। তুলনামূলক কম পাওয়া গেছে বর্ষায় (২৪.৩৮ মিলিগ্রাম/লিটার)। ফলে গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার আটটি স্থানের কোনোটিই মাছ চাষের উপযুক্ত নয়।
পানির স্বচ্ছতা বা দৃশ্যমানতা হেমন্তকালে সর্বাধিক ছিল, বছিলা সেতু, হাজারীবাগ ও সদরঘাট এলাকায় তা ২৫ ইঞ্চিরও বেশি। তবে বসন্ত ও শীতকালে স্বচ্ছতা গড়ে মাত্র ৯ ইঞ্চিতে নেমে আসে।
বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে বসন্তকালে—গড়ে ৯১৭ মাইক্রোসিমেন্স/সেন্টিমিটার। বর্ষায় তা কমে দাঁড়ায় ১৮২ মাইক্রোসিমেন্সে। যদিও এই মান সর্বোচ্চ সহনীয় সীমার (১২০০ মাইক্রোসিমেন্স) নিচেই ছিল।
ছয় মৌসুমে নদীর গড় তাপমাত্রা ছিল ২৭.৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতে সর্বনিম্ন (২৩.১৩) এবং গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ (২৯.৩২) তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে পানির ঘোলাটে ভাব অনুমোদিত সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
অন্যদিকে বুড়িগঙ্গার গড় পিএইচ মান ছিল ৭.৭৩, যা মাছ চাষ ও শিল্প—উভয় ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য সীমার (৬–৯) মধ্যে। ক্ষারত্বও সাধারণত উদ্বেগজনক মাত্রা ছাড়ায়নি। তবে ধোলাইখালে টিএসএস অনুমোদিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া গেছে। টিডিএস যদিও নির্ধারিত মানের মধ্যে ছিল।
গবেষণার নেতৃত্ব দেওয়া ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন,
“বুড়িগঙ্গা নব্বইয়ের দশকেই তার খরস্রোতা রূপ হারিয়েছে। এখন এটি পরিণত হয়েছে দূষণের নদীতে। পয়ঃপ্রণালী ও শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য প্রতিনিয়ত নদীতে পড়ছে, যা পানির গুণগত মানকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।”
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন,“বুড়িগঙ্গাকে পুনরুদ্ধারে তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবে—প্রথমত, শিল্পবর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্যের আধুনিক পরিশোধন ব্যবস্থা; দ্বিতীয়ত, নদীতে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনা; তৃতীয়ত, তলদেশ থেকে আবর্জনা সরিয়ে গভীরতা ও প্রশস্ততা বৃদ্ধি। এগুলো একসঙ্গে করা গেলে নদীকে বাঁচানো সম্ভব।”
গত ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নদী বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, ঢাকা ও আশপাশের তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদী পুনরুদ্ধারে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে জটিল সমস্যার কারণে এই তালিকায় বুড়িগঙ্গা অন্তর্ভুক্ত নয়।
তার ভাষায়, “বুড়িগঙ্গার সমস্যা খুবই জটিল। শুধু ড্রেজিং করলেই এর সমাধান হবে না। তলদেশে হাজার হাজার টন পলিথিন জমে আছে। এগুলো সরালেও সমাধান মিলবে না। দেড় বছরে এর কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”
আজ রবিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব নদী দিবস। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার এ দিবস পালিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে রাজধানীর প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদী এখনও দখল ও দূষণের করালগ্রাসে বন্দী হয়ে ধুঁকছে।

