
মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ: পুনর্জাগরণের একমাত্র পথ
তৌফিক সুলতান:
মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হলে তাদের ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরি। মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণের জন্য ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই—এমনটাই জানিয়েছেন বিশিষ্ট গবেষক তৌফিক সুলতান। ইসলামের সূচনালগ্নে মদিনায় রচিত ‘মদিনা সনদ’ কেবল শান্তি চুক্তি ছিল না, এটি বহু-ধর্মীয় ও বহু-গোত্রীয় সমাজের রূপরেখা। এতে ইহুদি, খ্রিস্টান ও অন্যান্য পৌত্তলিক গোত্রসহ সবাইকে সমান নাগরিক মর্যাদায় অন্তর্ভুক্ত করে এক “উম্মাহ” গড়ে তোলা হয়েছিল, যা বদর ও উহুদের কঠিন পরীক্ষায় মুসলিম সমাজকে অটুট রেখেছিল।
রাসূল (সা.)-এর পর খুলাফায়ে রাশেদিনের যুগে ঐক্য প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। খলিফা উমর (রা.)-এর ন্যায়বিচারভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা বিশাল মুসলিম শাসনাঞ্চলে স্থিতিশীলতা এনে দেয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বায়তুল মাল ছিল সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের মডেল, যা সবার মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করত এবং জনতার বিশ্বাস অর্জনে কার্যকর ছিল।
আব্বাসীয় খিলাফতের সময় বাগদাদের “বাইতুল হিকমাহ” বিশ্বজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। গ্রিক, ফার্সি, ভারতীয় ও অন্যান্য সভ্যতার জ্ঞান এখানে সংরক্ষণ ও উন্নত হয়, যা পরবর্তীতে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পথ প্রশস্ত করে। আন্দালুসের কর্ডোবা গ্রন্থাগারও মুসলিম ঐক্যকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক মহাসড়কে রূপান্তরিত করেছিল।
কিন্তু মুসলিম ইতিহাসে রাজনৈতিক বিভাজন ও গোত্রীয় কোন্দল ঐক্যের শৃঙ্খল ভেঙে দেয়। কারবালার ঘটনা গভীর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করে। ১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের হাতে বাগদাদের ধ্বংসযজ্ঞ শুধু শহর নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিদর্শনও বিনষ্ট করে দেয়। মামলুক সুলতানরা সাময়িকভাবে ইসলামী সভ্যতা রক্ষা করলেও কেন্দ্রীয় ঐক্য পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি।
অটোমান, সাফাভী ও মুঘল সাম্রাজ্য আঞ্চলিক ঐক্যের কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হলেও পরস্পরের প্রতিযোগিতা ও সংঘাত মুসলিম ঐক্যকে দুর্বল করে তোলে। ১৯১৬ সালের সাইকস-পিকট চুক্তি ও ১৯২৪ সালে অটোমান খিলাফতের বিলুপ্তি মুসলিম বিশ্বকে কৃত্রিমভাবে বিভক্ত করে আজকের সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে।
আজ মুসলিম বিশ্ব রাজনৈতিক বিভাজন, অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাদপদতা এবং সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ইসলামের ভুল সংযোগের মতো জটিল সমস্যার সম্মুখীন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ ও সংহত উদ্যোগ, নতুন “বাইতুল হিকমাহ” ও আধুনিক “বায়তুল মাল” এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংলাপ।
তৌফিক সুলতান বলেন, “ইতিহাস প্রমাণ করেছে, যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম, তখন বিশ্বসভ্যতাকে আলোকিত করেছি; যখন বিভক্ত হয়েছিলাম, পিছিয়ে পড়েছি। তাই আজ জাতি, গোত্র ও মাযহাবের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সমগ্র উম্মাহকে একত্রিত করার সময়।” তিনি কুরআনের আয়াত (সূরা আলে ইমরান: ১০৩) উদ্ধৃত করে বলেন, “তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু শক্তভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।”
